
ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস অনেক অনুষ্ঠানে, বক্তব্য এবং সফরের মাধ্যমে, ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে সম্মান এবং এর সংস্কৃতি ও শিল্পের প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ২০১৩ সালে, তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে পবিত্র কুরআন বোঝার জন্য তিনি আরবি শিখছেন। তার ইসলামী চিন্তাভাবনা এবং অধিবিদ্যার সম্পর্কে জ্ঞান ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে অতুলনীয়।
অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজ-এ ‘ইসলাম এবং পশ্চিম’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় রাজা তৃতীয় চার্লস বলেছিলেন, ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্ম একটি সাধারণ একেশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং তা হল এক ঈশ্বরে বিশ্বাস।’
রাজা চার্লস বলেছিলেন, ‘আমাদের পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী সময়ে আমাদের কর্মের জন্য আমাদের জবাবদিহিতা এবং ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে আমরা অনেক মূল মূল্যবোধ ভাগ করে নিই। যেমন, জ্ঞানের প্রতি সাধারণ শ্রদ্ধা, ন্যায়বিচার, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতি মমতা, পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা।’
চার্লস বলেছিলেন, ‘মধ্য এশিয়া থেকে আতলান্তিকের তীর পর্যন্ত মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্ব এমন একটি বিশ্ব ছিল, যেখানে প-িত এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরা সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু আমরা ইসলামকে পশ্চিমাদের শত্রু, একটি বিদেশী সংস্কৃতির সমাজ এবং বিশ্বাস ব্যবস্থা হিসাবে দেখার প্রবণতা দেখিয়েছি বলে আমরা আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের সাথে এর মহান প্রাসঙ্গিকতা উপেক্ষা করেছি বা মুছে ফেলেছি।’
রাজা ৩য় চার্লস আরও বলেছিলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ, আমরা ৮ম থেকে ১৫শ শতাব্দীর মধ্যে স্পেনে ৮শ’ বছরের ইসলামী সমাজ ও সংস্কৃতির গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করেছি। মুসলিম স্পেন কেবল প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার বৌদ্ধিক বিষয়বস্তু সংগ্রহ ও সংরক্ষণই করেনি, বরং সেই সভ্যতার ব্যাখ্যা ও প্রসারও ঘটিয়েছে। এবং বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, আলজেবরা নিজেই একটি আরবি শব্দ, আইন, ইতিহাস, চিকিৎসা, ঔষধবিদ্যা, আলোকবিদ্যা, কৃষি, স্থাপত্য, ধর্মতত্ত্ব এবং সঙ্গীতের মতো মানব প্রচেষ্টার অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।’
চার্লস বলেন, ‘দশম শতাব্দীর কর্দোবা ছিল ইউরোপের সবচেয়ে সভ্য শহর। আমরা সেই সময়ে স্পেনের গ্রন্থাগারগুলিকে ধার নেয়ার কথাও জানি। রাজা আলফ্রেড এই দেশের রন্ধনশিল্প নিয়ে ভয়াবহ হিমশিম খেয়েছিলেন। বলা হয় যে দেশটির শাসকদের লাইব্রেরিতে এর ৪ লাখ খ- ছিল, যা বাকি ইউরোপের সমস্ত লাইব্রেরির একত্রিত বইয়ের চেয়েও বেশি।’
এটি সম্ভব হয়েছিল কারণ মুসলিম বিশ্ব অমুসলিম ইউরোপের বাকি অংশের চেয়ে ৪শ’ বছরেরও বেশি সময় আগে চীন থেকে কাগজ তৈরির দক্ষতা অর্জন করেছিল। আধুনিক ইউরোপ যে বৈশিষ্ট্যেও জন্য গর্ব করে, তার অনেক কিছুই এসেছে মুসলিম স্পেনের কূটনীতি, মুক্ত বাণিজ্য, উন্মুক্ত সীমান্ত, নৃবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার কৌশল, শিষ্টাচার, ফ্যাশন, বিকল্প চিকিৎসা, হাসপাতাল থেকে। এই সবই এসেছে এই মহান নগরী থেকে।’
চার্লস বলেন, ‘মধ্যযুগীয় ইসলাম ছিল তার সময়ের জন্য অসাধারণ সহনশীলতার ধর্ম, যা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিশ্বাস পালনের অধিকার প্রদান করে এবং এমন একটি উদাহরণ স্থাপন কওে, যা দুর্ভাগ্যবশত পশ্চিমে বহু শতাব্দী ধরে অনুকরণ করা হয়নি।’
চার্লস বলেন, এটা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ইসলাম ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি অংশ, এটি অভিবাসীদের থেকে আলাদা কোন বহিরাগত নয়, এটি ইউরোপের নিজস্ব ইতিহাসের অংশ। মানব প্রচেষ্টার সকল ক্ষেত্রে ইসলাম আমাদের অতীত এবং বর্তমানের অংশ। এটি আধুনিক ইউরোপ তৈরিতে সাহায্য করেছে, এটি আমাদের নিজস্ব উত্তরাধিকারের অংশ, আলাদা কিছু নয়।’
রাজা চার্লস বলেছিলেন, ‘এছাড়া, ইসলাম আজ আমাদেও পৃথিবীকে বোঝার এবং বসবাস করার এমন একটি উপায় শেখাতে পারে, যেখানে খ্রিস্টধর্ম নিজেই ইসলামের কেন্দ্রবিন্দুতে হারিয়ে যাওয়ার জন্য দরিদ্র। ইসলামের মূলে রয়েছে মহাবিশ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণ। ইসলাম মানুষ ও প্রকৃতি, ধর্ম ও বিজ্ঞান, মন ও পদার্থকে পৃথক করতে অস্বীকার করে এবং নিজেদের ও আমাদের চারপাশের জগতের একটি আধা আধ্যাতিক এবং ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণ করে। ‘
একটি ওয়েব কনফারেন্সের বক্তৃতায় রাজা ৩য় চার্লস ধর্মান্তরিত ফরাসি মুসলিম রেনে গুয়েননের লেখা বই ‘দ্য রেইন অফ কোয়ান্টিটি’-এর প্রশংসা করে বলেছিলেন, তার বইটি আমাদেরকে আমাদের সত্তার ধরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এবং সম্ভবত কারণ এই যে, আধুনিকতার আকারে এমন একটি মতাদর্শ নিয়ে আমাদেরকে প্রশ্ন তুলতে বলে, যা আমাদের মনে এতটাই প্রতিষ্ঠিত, যে অন্য কোনও সত্তার অস্তিত্ব এক অর্থে কাল্পনিক এবং অবাস্তব বলে মনে হয়।
রাজা তৃতীয় চার্লস অধ্যাপক সাইয়্যেদ নাসরের একজস অনুরাগী। তিনি ধর্মান্তরিত ইংরেজ লেখক মার্টিন লিংস-এর ‘এ রিটার্ন টু দ্য স্পিরিট’ বইয়ের ভূমিকা লিখে নীচে নিজের নাম চার্লস স্বাক্ষও করেছিলেন। তিনি ভূমিকয় যে কথাগুলি লিখেছিলেন, তার মধ্যে একটি হল, ‘মার্টিন লিংসের অন্যতম সেরা উপহার হল নবী মোহাম্মদের অসাধারণ জীবনী।’