নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি, তৃণমূল থেকে সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন একসঙ্গে করা ও রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ। গতকাল বুধবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে নিজের প্রস্তাবগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরেন।
মোহাম্মদ আবদুর রউফের প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় মানুষকে সরাসরি যুক্ত করার মতো অভিনব প্রস্তাবও। এদিকে একই দিন সংস্কার কমিশনকে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে ছিল কমিশনের ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা বাড়ানোর বিভিন্ন উপায়।
সাশ্রয়ের জন্য একসঙ্গে সব ভোট
বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একই সঙ্গে ভোট গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন। সাবেক এই সিইসির মতে, তাহলে বারবার ভোট গ্রহণ করে এত অর্থ ব্যয় করতে হবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত ছয়টি (জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচন করি। তবে সংসদ নির্বাচনে যে দল সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে, তার প্রতিনিধিই সংশ্লিষ্ট ইউপিতে যাবে। কাজেই এক নির্বাচনেই সব শেষ করা যায়। এতে কাগজ নষ্ট, অর্থ ব্যয় কমে আসবে।’
আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে মত
আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘এতে মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ হবে। আবদুর রউফ বলেন, মনোনয়নপত্র-বাণিজ্যটাই নির্বাচনকে ব্যবসার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। ‘২০ কোটি টাকা দিয়ে কিনব, ১০ কোটি টাকা ছড়াব। পাঁচ বছর থাকলে দুই শ, আড়াই শ কোটি টাকা লাভ করব, সোজা হিসাব। এমপির চরিত্র নষ্ট হচ্ছে এ জন্য। কাজেই আনুপাতিক হারে নির্বাচন করুন।’
আবদুর রউফ বলেন, ভোটের আগে তৃণমূলে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচন করে দলগুলো ইসিকে তালিকা দেবে। ইসি লোকটা ভালো কি মন্দ, বুঝতে জনগণের মতামত নেবে। আপত্তি পেলে তাঁকে বাদ দেওয়া হবে। ফুটবলের খেলোয়াড় বদলের যেমন সুযোগ থাকে, তেমন করে বছরে ৫ শতাংশ প্রার্থী বদলের সুযোগ থাকবে।
ভোটপ্রক্রিয়ায় জনগণকে যুক্ত করা
দেশের সাধারণ মানুষকে দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে ভোট চালানোর পরামর্শ দিয়ে আবদুর রউফ বলেন, ‘কোনো ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ কিচ্ছু নেবেন না। সাধারণ মানুষের মনকে দৃঢ় করেন। তাঁরা দেশের মালিক। তাঁদের ওপর দায়িত্ব দেন। স্থানীয় ভোটকেন্দ্রগুলো স্থায়ী করেন। আড়াই লাখ ভোটকেন্দ্রের কোনোটিতে ৫০০-এর বেশি ভোটার থাকবেন না। ভোটার ক্লাব করেন। ১১ জনের নির্বাহী কমিটি থাকবে। ৫ জন মহিলা, ৬ জন পুরুষ। তাঁরা ভোটটা চালাবেন।
সাবেক সিইসি বলেন, ছাত্র-জনতা শিক্ষিত যাঁরা আছেন, তাঁরা স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা দেখবেন। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে। ১ ঘণ্টায় গণনা শেষ করে ফল মোবাইলে উপজেলা, জেলা সব পর্যায়ের নির্বাচন অফিসে চলে যাবে। ফল পাল্টে দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
আনুপাতিক পদ্ধতির বিষয়ে কোনো কোনো দলের আপত্তি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রউফ বলেন, ‘সব দল চায় না। কয়টা দল আছে যে, আইন অনুসরণ করে হয়েছে? যে দেশের দলের মধ্যে গণতন্ত্র নাই, তারা কী করে গণতন্ত্র কায়েম করতে পারে?’
সাবেক সিইসির দেওয়া মতামত প্রসঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাঁর (আবদুর রউফ) অনেক অভিজ্ঞা, অনেক প্রজ্ঞা। তিনি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।’
বদিউল আলম প্রসঙ্গক্রমে কয়েকদিন আগেই আরেক সাবেক সিইসি আবু হেনার মতামত নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। আবু হেনা তখন বলেছেন, আনুপাতিক নির্বাচনের দরকার নেই। অন্যদিকে কোনো কোনো মহল প্রস্তাব করলেও দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু করার দরকার নেই বলে অভিমত দিয়েছেন আবদুর রউফ।সব নির্বাচন একসঙ্গে করার পরামর্শ সাবেক সিইসি রউফের
ইসির কর্মকর্তারা চাইলেন ক্ষমতায়ন
নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ভোটের পর সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো যেন হয়রানি করতে না পারে সে সুরক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। গতকাল নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এ প্রস্তাব দেন ইসির কর্মকর্তারা। তাঁরা নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এখতিয়ারের বাইরে হস্তক্ষেপ বন্ধেরও দাবি জানান। নির্বাচনী অনিয়মে যুক্তদের ইসি যে সাজা দিয়ে থাকে, তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তাঁরা।
বৈঠকের পর ইসি সচিব শফিউল আজিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইসিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা আইনের মাধ্যমে আরও সুনির্দিষ্ট করার প্রস্তাব দিয়েছি। নির্বাচনে আইনগত কর্তৃত্বের বাইরে হস্তক্ষেপ কোত্থেকে কীভাবে হয়, তা নিয়ে আমরা খোলামেলা আলোচনা করেছি।’ এ ক্ষেত্রে মিডিয়ারও নিরপেক্ষ আচরণ কামনা করেন তিনি।
এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের অগাধ ক্ষমতা থাকলেও বিগত দিনে তা প্রয়োগে সমস্যা ছিল। এ সমস্যা দূর করতে হবে। আমাদের আইনকানুন, বিধিবিধানকে আরও শক্তিশালী, কার্যকর করা দরকার। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আইন প্রয়োগ করা।